--লেখকঃ Khalid Hasan ---
-------দশম পর্ব --------
.রাজ্যটায় একটা অন্ধকার ভাব চলে এসেছে। সম্ভবত রাত হয়েছে। এখানে রাত দিন বুঝার কোনো উপায় নেই। সারাক্ষণ জ্যোৎস্না রাতের মতো ঝলমলে থাকে। কিন্তু নেই কোনো চন্দ্র নেই কোনো সূর্য। আলোর উতসই বা কি সেটাও বুঝতে পারলাম না। আমি বসে আছি রাজমহলের সামনে একটা ফুলের বাগানে। সেখানে একটা দোলনা আছে। সেই দোলনায় বসে বসে ভাবছি। ভাবছি কিভাবে এখান থেকে বের হবো। মনে হচ্ছে আমার চেনা পৃথিবী টাকে অনেক বছর ধরে দেখিনা। যেতে ইচ্ছা করছে খুব। এখানে খাওয়ার জন্য ফলমূল ছাড়া কিছু নেই। রবিনকে হুকুম দিয়েছি আমার কয়েদি বন্ধুদের জন্য ফল পাঠানোর। সে হুকুম পালনে ব্যস্ত। দূর থেকে দেখলাম সাদা ড্রেস পড়া মায়া এদিকেই আসছে। পিছনে পিছনে কিছু দাসী। এই পোশাকে তাকে একদম পরীদের মতো লাগছে। কি অপরূপ তার সৌন্দর্য। হঠাৎ মনে পড়ে গেলো রবিনের বলা কথাটা ,এই রাজ্যের সবাই মৃত। ওহ নো। এই মায়া পরীও নিশ্চয়ই মৃত। সে যতই কাছে আসছে আমার ততই ভয় করছে।ইশারায় দাসীদের সেখান থেকে যেতে বললো। দাসীরা চলে গেলো । সে এসেই দোলনার একপাশে বসে পড়লো। আমি ভয়ে একটু গুটিসুটি করে বসলাম। মুখ দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোচ্ছে না আমার। চুপ করে বসে ভাবতে লাগলাম কপালে কি আছে ..
.
--কি রাজামশাই নিজের রানীর সাথে কথা বলবেন না?
মায়ার কথায় আমার ঘোর কাটলো। মায়া তাকিয়ে আছে আমার দিকে এক দৃষ্টি দিয়ে। চোখে চোখ পড়তেই বুকটা কেপে উঠলো আমার। এই চোখে কি জাদু আছে নাকি! একদম বাদামি চোখ।চোখের দিকে তাকালে মনে হয় ওই চোখের কোনও প্রাণ নেই। আমার ভয় করতে লাগলো খুব।মায়ার দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। ভয়ে ভয়ে নিচে তাকিয়ে থাকলাম। মায়া আবার জিজ্ঞেস করলো..
--কি হলো রাজা মশায়! কথা বলবেন না?
--ইয়ে মানে ইয়ে .. ভয়ে আমার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না .. তারপরও জোর করে বললাম
--আমার এখানে খুব ভয় করছে। মনে হচ্ছে মৃত মানুষদের সাথে আছি। সবাই যেনো কেমন করে তাকায়। মনে হয় সবাই নিষ্প্রাণ।
মায়া আমার কথায় হাহা করে হাসতে লাগলো। এমন হাসি যেনো ডাইনিরাই দিতে পারে। আলিফ লায়লায় এমন অনেক ডাইনি দেখেছিলাম যারা মায়ার মতো এভাবে হাসে।
--ঠিকই বলেছো যুবক সবাই নিষ্প্রাণ। আর এখানে এলে সবাই নিষ্প্রাণ হয়ে যায়।
..আমি মায়ার কথায় আরো ভয় পেয়ে গেলাম। মায়া ঘোর লাগা দৃষ্টি দিয়ে এখনো তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অদ্ভুত সেই তাকানোর ভঙ্গি। একবারও তার চোখের পলক পড়ছে না। ঠোঁটের কোনায় এক নিষ্ঠুর হাসি। হঠাৎ সে ঘপ করে আমার হাত ধরে ফেললো। আমি চমকে উঠলাম। উহ কি শীতল তার হাত। মায়া আসলেই একটা মৃত। এতো ঠান্ডা শরীর কোনো জীবিত মানুষের হতে পারে না।
.
--কি রাজামশাই .. রানীর সাথে রোম্যাঞ্চ করবেন না,?
--অ্যাঁ .. হ্যাঁ হ্যাঁ
--আমাকে কি ভয় পাচ্ছো নাকি?
--কই নাতো .. কিসের ভয়.. আমার রানীকে আমি ভয় পাবো কেনো! আমি তো শুধু অবাক হয়ে ভাবছি এতো সুন্দর রূপ কিভাবে পেলে তুমি। তুমি অনেক সুন্দরী।
--বাহ রাজামশাই দেখি মেয়েদের ভালোই প্রসংশা করতে জানে।
--হুম তা তো হবেই .. আমার রানীর মতো সুন্দরী কেউ নেই।
এইসব বলার সাথে সাথে মায়া আমার হাতটা তার গালে ছোয়ালো।আমার হাতে নাক ঘষে ঘষে উষ্ণতা অনুভব করতে লাগলো চোখ বন্ধ করে।আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম তার কান্ড । এরপর তার বুকের বামপাশের উপর হাতটা ধরে রাখলো আমার।কি আজব ওর বুকে হৃদয় স্পন্দন নেই।
--এখনো ভয় করছে তোমার?
--আরে না কি যে বলো
--হুম আমার রাজা বলে কথা ভয় থাকা চলবে না। তবে আমাকে বিয়ে করার আগে তোমারো হৃদ স্পন্দন থামাতে হবে হাহা হা
--মানে!!!!
--মানে মৃত হতে হবে আমাদের মতো।
--কিহহহ!!!!!
--একি ভয় পেলে নাকি?
--ইয়ে নাহ.. ভয় পাবো কেনো? হেহেহে আমার এতো সুন্দরী প্রিয়তমার জন্য আমি প্রাণ দিতেও রাজি আছি। অনেক কষ্টে কথাটা বললাম।
--হ্যাঁ এইতো আমার রাজার মতো কথা। এই নাহলে আমার রাজা।
--ইহ কি আমার রানী আইছেরে। খায়াদায়া কাম নাই ওর জন্যে প্রাণ দেই। আমি সুযোগ পাইলেই এইখান থেইকা চম্পট দিমু। শুধু অমাবশ্যার আগে এইখান থেকে পালানোর রাস্তাটা খুজে পাইলেই হয়।( কথাগুলো মনে মনে বললাম আমি।)
.
--তোমার কি এখনো এখান থেকে যাওয়ার ইচ্ছা আছে নাকি পালানোর ইচ্ছাটা উবে গেছে?
--কি যে বলো তুমি রাজত্ব আর এতো সুন্দর রানী কে ছেড়ে যাবো। তাহলে তো বোকামি হয়ে যাবে।
--এইতো বুদ্ধিমান ছেলেদের মতো কথা। আমি এটাই ভেবেছিলাম। অমাবস্যা কিন্তু আর বেশি দূরে নয়। খুব অল্প দিনের অপেক্ষার পর আমরা এক হয়ে যাবো। এরপর সৃষ্টি হবে এক নতুন শক্তির। তারপর এই পৃথিবীর বুকে আমরাই রাজত্ব শুরু করবো। সারা পৃথিবী জুরে তৈরি হবে আমাদের সাম্রাজ্য। সমস্ত পৃথিবী বাসীকে গোলাম বানিয়ে রাখবো আমরা দুজন।
..মেয়ে বলে কি এসব! পাগল হয়ে যাবো দেখছি। হঠাৎ রবিন এসে আমাদের সামনে হাজির। এসেই আমাকে বললেন ..
--খালিদ তোমার বন্ধুদের খাবার দিয়ে এসেছি।
মায়া তখনো আমার হাত ধরে বসে ছিলো। রবিনের কথায় মায়া আমার হাত ছেড়ে দিলো। আর রবিনের দিকে রাগি দৃষ্টি দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো..
--গোলামের বাচ্ছা কখন কোথায় কিভাবে আগমন করতে হয় জানিসনা? আর তোর সাহস হয় কি করে মহারাজের নাম ধরে ডাকার।
মায়ার রাগ দেখে আমি চমকে উঠলাম। একটা সুন্দরী মেয়ের এতো রাগ কি করে হয়।
--মাফ করবেন রানীমা আমার ভুল হয়ে গেছে।মাথা নিচু করে বললো রবিন। আমি আর চুপ না থেকে বললাম ..
--মায়া ছেড়ে দাও। আসলে আমি ওকে নাম ধরে ডাকতে বলেছি। মহারাজ মহারাজ শুনতে কেমন অসস্তিকর লাগে। এই যুগে কি এইসব ডাক ভালো লাগে শুনতে বলো?
--ওহ তুমি বলেছো, আচ্ছা তোমার যা ইচ্ছা। কিন্তু ও হুট করে আমাদের কথা বলার মাঝখানে আসলো কেনো এর জন্য ওকে অনেক বড় শাস্তি পেতে হবে।আমাদের প্রেমালাপের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে।
--মায়া আমি বললাম না ছেড়ে দাও। এতটুকু কারণে রেগে গেলে চলে?
--ওকে শাস্তি দিবোনা?
--না, আমি বললাম তো।
--ঠিক আছে। তুমি বললে তাই ওকে মাফ করে দিলাম।
--হুম।
রবিন এখনো মাথা নিচু করে আমাদের সামনে দাড়িয়ে আছে। মায়া ধমক দিয়ে বললো ..
--এখান থেকে যা বলছি। দেখছিসনা আমার রাজার সাথে জরুরি বিষয়ে কথা বলছি।
রবিন হন হন করে চলে গেলো সেখান থেকে।
.
রবিন চলে যেতেই আবার মায়া তার শীতল হাত দিয়ে আমার দুহাত ধরলো..
--এই জানোয়ার গুলোকে ভদ্রতা শেখাতে পারলাম না।
--আহ বাদ দাও তো ওইসব। তোমার বয়স কতো গো?
--৩০০+
--কি বলো এইসব! তিনশো বছর কেউ বাচে নাকি?
--তুমি দেখছি ভুলে যাচ্ছো, আমরাতো মৃত।
--তাহলে তো দেখছি তুমি আমার দাদীর দাদী তার দাদীর থেকেও বুড়ি। আচ্ছা তোমার এই রূপের রহস্য কি?
--তাজা রক্ত
মায়ার কথায় আবার চমকে উঠলাম। বলে কি এসব।
--তাজা রক্ত মানে!
--প্রতি অমাবস্যার রাতে তাজা রক্ত খেলেই আমার রূপ যৌবন বহুগুণে বেড়ে যায়।
--ওহ তাই বুঝি!!! আচ্ছা তুমি মরে গেলে কিভাবে?
--তুমি কি এইসব বলবে নাকি প্রেমালাপ করবে? এতকিছু তোমার জানতে হবেনা। রেগেমেগে বললো মায়া। রাগ দেখে ভয় পেয়ে গেলাম আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।
--আচ্ছা ঠিক আছে আর জিজ্ঞেস করবো না কিন্তু প্রেমালাপ কিভাবে করে আমিতো জানিনা কোনোদিন করিনি।
--আচ্ছা আজ আর প্রেম করতে হবেনা। পরে প্রেম করার অনেক সময় পাওয়া যাবে। এখন আমি অন্দরমহলে যাচ্ছি ঘুমাবো। তুমি রাজা না হওয়া পর্যন্ত আমার সাথে রাতে থাকতে পারবে না। তাই তোমার জন্য রাজমহলের সবচেয়ে সজ্জিত কক্ষে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারপর মায়া আমাকে জরিয়ে ধরলো। আর কানে ফিসফিস করে বললো,আর কটা দিন অপেক্ষা করো তারপর একসাথে রাত জেগে গল্প করবো। আর মন ভরে ভালোবাসা দিবো তোমায়। আচ্ছা তাহলে আমি যাচ্ছি। রবিনকে বলে দিবো ও তোমার শয়ন কক্ষ দেখিয়ে দিবে।
.
এরপর মায়া দোলনা থেকে উঠে চলে যেতে লাগলো। যাওয়ার সময় আবার পিছনে ফিরে আমার দিকে তাকালো। একটা হাসি দিয়ে চলে গেলো সে।ডাইনিদের মতো হাসি।উফ গায়ে কাটা দেয়ার মতো।
.
আপদটা গেছে। ইহ মামার বাড়ির আবদার। সবে বিয়ের বয়স হয়েছে আর আমি তার জন্য মরতে যাবো। নিকুচি করি তোর রাজা আর রাজত্ব। ভালোয় ভালোয় জান নিয়ে পালাতে পারলে বাচি। উফ কি যে করি! অমাবশ্যার তো বেশিদিন নেই। কিন্তু কতদিন আছে বাকি কে জানে। জানতে পারলে ভালো হতো। আমি দোলনাতে বসে বসেই ভাবতে লাগলাম। হঠাৎ রবিন এসে আমার সামনে হাজির।
--মহারাজ আপনি কি এখনই ঘুমাতে যাবেন?
..নিকুচি করি তোর ঘুমের। জীবন নিয়ে টানাটানি আর ও ঘুম নিয়ে পরে আছে ।
--নাহ .. আর এতো ফর্মালিটি দেখাতে হবেনা। খালিদ বলেই ডেকো। আর এখানে বসে পড় আমার পাশে একটু গল্প করি।
রবিন আমার কথা অক্ষরে পালন করলো।
--আচ্ছা রবিন রানী মারা গেলো কিভাবে? আর এইখানে এইসব কিভাবে হচ্ছে আমাকে একটু খুলে বলবে কি?
আমার কথায় রবিন মাথা নিচু করে ফেললো।
--খালিদ, এইসব বলা রানীর নিষেধ আছে। উনি যদি জানতে পারে তাহলে আমাকে নিমিষেই শেষ করে ফেলবে। তবে মারতে পারবে না আমাকে। নরক যন্ত্রণা দিবে। আমরা তো অনেক আগেই মরেছি।
--আরে ভাই বলনা। আমিও তো কদিন পর তোমাদেরই একজন হয়ে যাবো। বললে কি সমস্যা?
--হ্যাঁ তা ঠিক। কিন্তু জীবিতদের এ ব্যাপারে বলা নিষেধ আছে।
--রবিন আমি কিন্তু তোদের রাজা ভুলে যাসনা। আমার হুকুম অমান্য করা তোর কিন্তু ঠিক হচ্ছেনা। আমি চাইলেই রানীকে দিয়ে তোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারি। তোদের রানী কিন্তু বর্তমানে আমার দেওয়ানা.. আমি যা বলবো তাই শুনবে।
আমার কথা শুনে রবিন অসহায় দৃষ্টি তে তাকালো।
--তাহলে কথা দিতে হবে যে আমি বলেছি তা তুমি রানীকে জানাবে না।
--আচ্ছা ঠিক আছে জানাবো না। এইবার বল এতোকিছু র রহস্যটা কি? কিভাবে এইসবের সূত্রপাত হয়েছে?
রবিন নড়েচড়ে বসলো। আমি অধীর আগ্রহে কান পেতে রইলাম রবিনের দিকে। অবশেষে রবিন বলতে শুরু করলো এইসব রহস্যের শুরুর ঘটনা।
.
--ঘটনার সূত্রপাত শুরু হয় আজ থেকে তিনশত বছর আগে। আমরা তখন জীবিত ছিলাম। আর আমরা শাহজালাল স্যারের সাথে জীববিদ্যার একটা বিষয় নিয়ে ল্যাবরেটরিতে রিসার্চের কাজে ছিলাম। শাহজালাল স্যার জীববিদ্যায় পিএইচডি করেছেন। অনেক বড় বিজ্ঞানী হয়ে গেছেন। তাই নিজেকে গবেষনার কাজে নিয়োজিত রেখেছেন।আমি মায়া এবং আরো কয়েকজন উনার এসিস্ট্যান্ট হিসেবে ছিলাম। কিন্তু সেবারে তিনি একটা অদ্ভুত বিষয়ের উপর গবেষণা শুরু করতে লাগলেন।তিনি এইবারে আবিষ্কার করতে চান কিভাবে মানুষের বয়সকে ধরে রাখা যায় আর মৃত্যুর পরও মানুষকে জীবিত করা যায়!!
...রবিনের কথা শুনে চমকে উঠে বললাম ..
--কিহ! কি অদ্ভুত রে বাবা। এইটা কি সম্ভব নাকি!
--তোমার মতো আমরাও তখন ঘাবড়ে গেছিলাম। তবে তিনি এমনটাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি তার গবেষণায় অটল ছিলেন।
--আচ্ছা যাইহোক তারপর ঘটনা বলো।
.
.
----চলবে -----
0 Comments
please Wait